নিজস্ব প্রতিবেদক:
চাকরিচ্যুত কারারক্ষী মনিরুল ইসলামের সাথে সাবেক ফ্যাসিবাদীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলো এবং ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় বিভিন্ন নেতার পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে নানা অনৈতিক কাজের সংগে জড়িত ছিলো।
জানা যায়, মনিরুল ইসলামের মিথ্যাচার ও ভন্ডামীর কারণে জেল অধিদপ্তরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের নিকট সে “বিক্লাস মনিরুল” নামে পরিচিত। সে একাধারে মাদক ব্যবসায়ী, মাদকসেবী ও অবৈধভাবে, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কারাভ্যন্তরে বন্দীদের নিকট মাদক ও নিষিদ্ধদ্রব্য প্রবেশ করান। এমনকি, কারাগারের ভিতরে ডিউটি করার সময় মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী বন্দীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে, বন্দীর স্ত্রী-সন্তান, ভাই তথা আত্মীয়ের মোবাইল নাম্বার নিয়ে তাদের বাড়িতে যায়, এমনকি বিকাশে টাকা এনে মাদকসহ নিষিদ্ধ দ্রব্যাদি কিনে অভিনব কৌশলে কারাগারের ভিতরে বন্দীদের নিকট সাপ্লাই দেয়। তার এহেন অপরাধ একাধিকবার সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ৪/৫ সাময়িকক বরখাস্ত হওয়াসহ চাকরিচ্যূত হয়েছিলো, এমন কি বউ পেটানোর দায়ে ফৌজদারী মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২/৩ বছর জেলও খাটছে নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে।
এছাড়াও মনিরুল ইসলাম বিভিন্ন বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, বিশেষ সুবিধা দেয়া এবং রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার করতো বলে জানা যায়। চাকরিরত থাকা অবস্থায় মনিরুল কারাগারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে একটি ভিডিও বক্তব্য সাংবাদিকদের দেয় যা সম্পূর্ণ নিয়ম বর্হিভূত ও কারা বিধির চরম লঙ্ঘন।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকার থাকা অবস্থায় সাংবাদিকদের মাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তা পাঠায় সেখানে কারারক্ষী মনিরুল ইসলাম বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি, সেই সঙ্গে তার পরিবারের সকল সদস্য শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ছোট সোনামনি শেখ রাসেলের শহীদী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্বকে; যার জন্ম না হলে ছোট্ট সোনার বাংলাদেশের নাম বিশ্বের ইতিহাসে ঠাই পেতো না। আবারও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার জন্ম না হলে জন্ম হতো না আপনার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব একজন সফল, স্বার্থক রাষ্ট্র নায়কের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আপনি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সকল প্রতিবন্ধকতা পিছনে ফেলে অদম্য সাহসিকতা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলে স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করে চলেছেন। আপনার অধীনস্থ কিছু ঘুষখোর, অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তারই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
মনিরুল বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার অধীনস্থ আমি একজন নিম্ন কর্মচারী, আমি একজন কারারক্ষী । আমার স্ত্রীর মেজো ভাই আব্দুল ওহাব একজন মুক্তিযোদ্ধা । মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমি অনুপ্রাণিত। দেশ তথা সকল স্তরের মানুষ কে ভালবাসতে , ভালোভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ও অনুদানে আপনার নেই কোন শেষ।
মনিরুল আরও বলেন, আপনার অধীনস্থ রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার আব্দুল জলিল স্যার, জেলার মো নিজামুদ্দিন, এবং কারা সদর দপ্তর রাজশাহী ডিআইজি প্রিজন মো কামাল হোসেন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই কারা আভ্যন্তরে আপনার পতনের বার্তা পৌঁছে দেন বন্দীদের মাঝে।
ড. মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসির কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যতবার তাদের সাথে দেখা করেছে ততবারই বলেছে এ সরকারের আমলে আপনাদের মামলা নিষ্পত্তি করা উচিত হয়নি এবং ফাঁসির সেলে ফাইল বসিয়ে তাদেরকে বলা হয়েছে চলমান সরকারের আমলে আপনারা মামলা পরিচালনা বন্ধ রাখেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনার পতন অনিবার্য। তাই তারা এ ধরনের বক্তব্য ও আশ্বাস তাদেরকে প্রদান করেছিলেন।”
এছাড়াও মনিরুল বলেন, “রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির বন্দীদের প্রাপ্য সিগারেট কারা বন্দীদের না দিয়ে ডিআইজি, জেল সুপার, মো আব্দুল জলিল ও জেলার নিজাম যোগসাজসে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে। ফাঁসির বন্দিদেরকে জোরপূর্বক পাকিস্তানি ফ্যান কিনতে বাধ্য করা হয় যাতে সাধারণ ফ্যানের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, মাদক সেবন বন্দীদের নিকট জুতার মধ্যে গাঁজাসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ দ্রব্য সহ তল্লাশিতে ধরা খাওয়া, স্ত্রী নির্যাতনের কারণে ফৌজদারী মামলায় ৩ বছর জেল খাটা সহ চারবার চাকরি হতে বরখাস্ত হয়েছে ও অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জেলবিধি অনুযায়ী বিভিন্ন গুরু ও লঘু শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কারা বিধিবহির্ভূত আচরণ, স্ত্রী নির্যাতন , মাদকসেবন, বিধিবহির্ভূতভাবে মাদকদ্রব্যসহ অন্যন্য অবৈধ নিষিদ্ধ দ্রব্য কারাগারের ভিতরে অনুপ্রবেশ ঘটানোসহ একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে কারারক্ষী মনিরুল ইসলাম (কারারক্ষী নং ৩২০৫৫) ২য় বারের মতো চাকরীচ্যুত (Dismissal) হয়। এতে সে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং উর্ধ্বতনের বিরুদ্ধে মিথ্যাসর্বস্ব গায়েবি অভিযোগ তুলে নামসর্বস্ব, অখ্যাত ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে অখ্যাত পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করায়।
চাকরিচ্যুতির পরও মনিরুল থেমে থাকেনি। তিনি উর্ধ্বতন কর্মকতা ও অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক, আজগুবি,ভিত্তিহীন গল্প তৈরী সহ অনিয়ম ও দুর্নীতির কথোপকথন এর অডিও রেকর্ড রাজশাহীর দুদক অফিসে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করে-যা উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেলার মো নিজাম উদ্দিন জানান, মনিরুল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে খারাপ আচরণ করতো এজন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এছাড়াও কারাবিধি ও আইনবহির্ভূত কাজ করেছে সে। জেল কোডের বিষয়ে ধারণা না থাকায় মনিরুল বিভিন্ন মহলে অনেক কিছু বলে বেড়াইতো যার কোনো সত্যতা নেই।
এ বিষয়ে বর্তমান জেলার মোঃ আমান উল্লাহ্ বলেন, মনিরুল বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলো। অবৈধ ওষুধ, চা পাতা ও মাদকদ্রব্য সহ তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। ধরা পরার পর মনিরুল উদ্বোধন কর্মকর্তাদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ করে এবং হুমকি প্রদান করে আমি আওয়ামীলীগ করি, আমার আত্মীয় মুক্তিযোদ্ধা।
এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিলকে মুঠোফোনে একাদিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান আব্দুল জলিলের তত্ত্বাবধানে থেকেই মনিরুল এসব কাজ করত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় কারা উপ-মহাপরিদর্শক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ঊর্ধ্বতনের অনুমতি ব্যতীত বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম করতো। এছাড়াও চাকরিবিধি ও কারাবিধি পরিপন্থী কাজ যেমন- প্রেসক্লাব সহ একাধিক স্থানে সংবাদ সম্মেলন; এর জন্য পরবর্তীতে ক্ষমাও চায় মনিরুল।
কামাল হোসেন আরও বলেন, মনিরুল ইসলাম মাদক সেবন করত। সুতরাং তিনি নেশার ঘোরে কখন কি বলেন তা ঠিক থাকে না।
সূত্রমতে আরও জানা যায় যে, তিনি বর্তমানে সরকার বিরোধী কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়াইছেন এবং ফ্যাসিবাদের দোসরের দালালি ছেড়ে জামাত-বিএনপির কর্মী হিসাবে নিজেকে জাহির করে বেড়াচ্ছেন, এমনকি বৃহত্তর রাজশাহীর জামাত-বিএনপির বড় বড় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তালিকাভূক্ত কর্মী বনে যাবর আপ্রাণ চেষ্টা মনিরুল করে যাচ্ছে। রাজশাহী বিভাগের সকল কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার প্রকৃত মুখোশ খুলে দিয়ে কারা অধিদপ্তরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা সহ ফ্যাসিবাদের দোসর, রাষ্ট্রদ্রহী এ ভন্ড ও মিথ্যুক’কে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছে।